শিশু কিন্তু মায়ের গর্ভে থাকাকালীন সময় থেকেই কানে শুনতে শুরু করে। জন্ম হওয়ার আগ পর্যন্ত মায়ের হৃৎস্পন্দন, পাকস্থলীর শব্দ, আশেপাশের মানুষের হালকা কথাবার্তার শব্দই ঘিরে থাকে শিশুর জীবন।

সাধারণত গর্ভধারণের ২৩ সপ্তাহের দিকে সে আশপাশের শব্দ শুনতে শুরু করে। আর ৩৫ সপ্তাহের মধ্যেই শিশুর কানের গঠন সম্পূর্ণ হয়ে যায় এবং তার শ্রবণ শক্তি পরিপক্বতা লাভ করতে শুরু করে এবং এই শ্রবণ শক্তি বৃদ্ধির ধারা তার জন্মের পরেও বজায় থাকে।

জন্মের পরপরই শিশুর কানের গঠন পুরোপুরি বিকশিত থাকলেও শ্রবণ শক্তির পরিপক্বতা লাভ করতে করতে প্রায় ছয় মাস লেগে যায়। মূলত এই দেরী হওয়ার কারণ দুইটি। প্রথমত, জন্মের পরে শিশুর মধ্য কর্ণের তরল পুরপুরি পরিষ্কার হতে বেশ খানিকটা সময়ে নিয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, শিশুর মস্তিষ্কের যে অংশটি শ্রবণ শক্তির ক্ষেত্রে কাজ করে সেটাও পরিপক্ব হতে বেশ সময় লাগে।

শিশুর শ্রবণ শক্তির ক্রমবিকাশ

নবজাতক
এই বয়সের শিশুরা একটু উঁচু শব্দ অথবা উচ্চ স্বরের প্রতি সাড়া দেয়, আর তাই স্বাভাবিক ভাবেই এই বয়সী শিশুদের সাথে যখন কেউ আদর করেও কথা বলেন তখন তারা একটু উচ্চ স্বরেই কথা বলে থাকেন।

তবে শিশু যে কোন শব্দে কিভাবে সাড়া দিবে সেটা নির্ভর করে শিশুটির মেজাজ ও প্রকৃতির উপর । অতিরিক্ত সংবেদনশীল শিশুরা যেখানে একটু বেশি সাড়া দিয়ে থাকে সেখানে শান্ত প্রকৃতির শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা তুলনামূলক কম সাড়া দিচ্ছে।

২ মাস বয়সী শিশু
দুই মাস বয়সের দিকে শিশুরা পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনলে সাধারণত শান্ত হয়ে যায় এবং “ওহ”, “উহ” এই ধরনের শব্দ করে। আপনি যখন শিশুর সাথে কথা বলবেন তখন শিশু যদি কথার মাঝে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে তাহলে শিশু কানে শুনছে না ভেবে ভয় পাবেন না।

তবে শিশু যদি একবারেই আপনার ডাকে সাড়া না দেয় তাহলে পরবর্তী রুটিন চেকআপের সময় এই ব্যাপারে ডাক্তারের সাথে আলাপ করে নিন।

৩ মাস বয়সী শিশু
তিন মাস বয়সের সময় শিশুর মস্তিষ্কের যে অংশগুলো শ্রবণ, ভাষা এবং গন্ধের ক্ষেত্রে কাজ করে সে অংশগুলো বেশ পরিপক্ব হয়ে উঠে। শিশুর মস্তিষ্কের এই অংশকে ডাক্তারি ভাষায় “টেমপোরাল লোব” বলা হয়ে থাকে।

এই সময়ে শিশু যখন আপনার কথা শুনবে তখন হয়ত সে সরাসরি আপনার দিকেই তাকাবে এবং কথা বলার চেষ্টা করতে গিয়ে সে হেসে অথবা শব্দ করে উঠতে পারে।

চার মাস বয়সী শিশু
চার মাস বয়সের সময় আপনার শিশু বেশ উৎসাহের সাথেই বিভিন্ন শব্দের সাথে সাড়া দিতে থাকবে। এমনকি আপনার কণ্ঠস্বর শুনলে সে হেসেও উঠতে পারে। আর এই সময়ে আপনি যখন কথা বলবেন তখন শিশু আপনার মুখের দিকে তাকাবে এবং আপনার নকল করার চেষ্টা শুরু করবে। এছাড়া এই সময়ে শিশু উম, ব এই ধরনের শব্দ করতে পারে।

ছয় মাস বয়সী শিশু
ছয় অথবা সাত মাস বয়সের সময় শিশু যে কোন শব্দের উৎস অর্থাৎ শব্দটি কোন দিক থেকে আসছে সেটা বুঝতে পারবে এবং সেই অনুযায়ী সেদিকে তাকাতেও পারে। এমনকি আশেপাশে খুব বেশি কোলাহল না থাকলে সে সামান্য শব্দেও সাড়া দিতে পারে।

বারো মাস বয়সী শিশু
১২ মাস বয়েসে শিশু তার প্রিয় কোন গান চিনতে পারবে এমনকি সে হয়তো তার প্রিয় গানের সাথে তালও মেলাতে পারে।

কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে?

সাধারণত বাবা-মা অথবা দাদা-দাদিই বেশীরভাগ সময় বুঝতে পারেন শিশুর শ্রবণ শক্তিতে কোন ধরনের সমস্যা হচ্ছে কি না, কেননা তারাই শিশুর সাথে বেশি সময় অতিবাহিত করে থাকেন।

আপনার যদি মনে হয় যে শিশু কম শুনছে অথবা শ্রবণ শক্তি জনিত কোন জটিলতায় ভুগছে তাহলে শিশুর বয়স তিন মাস হওয়ার আগেই তার নিয়মিত ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে একজন শ্রবণ শক্তি বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করে নিন।

এই ধরনের সমস্যা যদি প্রাথমিক দিকেই চিকিৎসা করে নেয়া যায় তাহলে আর অন্য আট দশটা বাচ্চার মতই আপনার শিশু শুনতে পারার সাথে সাথে সময় মত কথাও বলতে পারে।

যদিও বেশীরভাগ সময় শিশুর শ্রবণ শক্তি জনিত সমস্যার কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না, তবুও শ্রবণ শক্তি বিশেষজ্ঞ আপনাকে নিম্নের প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করে এর কারণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন:

– পরিবারের অন্য কারো মধ্যে কি শ্রবণ শক্তি জনিত জটিলতা আছে কি না
– গর্ভকালীন সময়ে অথবা প্রসবের সময় কি কোন ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে কি না
– নির্ধারিত সময়ের আগেই শিশুর জন্ম হয়ে গিয়েছিল কি না
– জন্মের সময় কি শিশুর ওজন কম ছিল কি না

এটা জেনে রাখা উচিৎ যেসব শিশুরা কানে শুনতে পায় না তাদের মধ্যে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ শিশুরই কানে শুনতে না পাওয়ার কারণ খুঁজে বের করা যায় না। এছাড়া অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণেও শ্রবণ শক্তি জনিত সমস্যায় শিশু ভুগতে পারে। আর তাই নিয়মিতই শিশুর নাক কান ও গলা পরীক্ষা করতে ভুলবেন না।

শিশুর শ্রবণ শক্তি জনিত সমস্যা যত দ্রুত ধরা পরে ততই ভালো। কেননা তাহলে সঠিক সময়ে শিশুকে চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ছয় মাস বয়সের আগে শ্রবণ শক্তির সমস্যায় আক্রান্ত যে সকল শিশুদের কানে শুনার যন্ত্রের মাধ্যমে তার শ্রবণ শক্তিতে সহযোগিতা করা হয় সে সকল শিশু সঠিক সময়েই কথা বলে এবং অন্যান্য আট দশটা বাচ্চার মতই তাদের ভাষার দক্ষতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

মূলপোস্ট: fairylandparents.quora.com